বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৬ পূর্বাহ্ন
মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ:
আমরা ভাবি, আমাদের জীবন আমাদের নিয়ন্ত্রণে এবং আমরা নিজেদের সুখ-দুঃখ নিজেদের মতো করে পরিচালনা করতে পারি। কিন্তু কখনো কখনো রোগব্যাধি বা নানা ধরনের বিপদ আমাদের জীবনকে স্পর্শ করে, যা গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় আমরা কোনোভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। বরং আমাদের জীবন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ কর্র্তৃত নিয়ন্ত্রিত। অসুস্থতা ও বিপদাপদের অনেক হেকমত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, এতে মুমিন বান্দার গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
গুনাহ মাফ : মুমিন নারী-পুরুষের জানা উচিত যে, কোনো বিপদই অকারণে আসে না। বিপদ আসার একটি হেকমত হলো, এতে গুনাহ মাফ হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, মুমিন নারী-পুরুষের ওপর, তার সন্তানের ওপর ও তার ধন-সম্পদের ওপর অনবরত বিপদাপদ লেগেই থাকে। সবশেষে আল্লাহর সঙ্গে সে গুনাহমুক্ত অবস্থায় মিলিত হয়।’ (তিরমিজি)
করুণায় আল্লাহ অনেক পাপ ক্ষমা করেন এবং কিছু পাপের জন্য বান্দাকে পরীক্ষা করেন যাতে সে সংশোধিত হয়। এটি পাপমোচনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যদি বান্দা তা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হৃদয়ে। আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলিমকে যে কোনো পরিশ্রম, যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ বা আঘাত স্পর্শ করুক, এমনকি একটি কাঁটাও যদি বিঁধে, তাহলে আল্লাহ এর মাধ্যমে তার গুনাহ মাফ করে দেন।’
আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা : মহান আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ায় শুধু জীবন-জীবিকা, সুখ-সুবিধা ও শান্তির জন্য সৃষ্টি করেননি, বরং তিনি বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘মানুষ কি মনে করে, ‘আমরা ইমান এনেছি’ এটা বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে? (তাদের কোনো) পরীক্ষা করা হবে না? (অথচ বাস্তবতা হলো) তাদের আগে যারা ছিল তাদের আমি পরীক্ষা করেছি। (তো তাদেরও তো পরীক্ষা করব)। আর এর মাধ্যমে আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করবেন কারা (তাদের ইমানে) সত্যবাদী, আর কারা (তাদের ইমানে) মিথ্যাবাদী।’ (সুরা আনকাবুত ২-৩)
এই পরীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হলো রোগব্যাধি। মানুষ যখন অসুস্থ হয়, তখন সে উপলব্ধি করে যে, তার দেহ, শক্তি ও ক্ষমতা কোনো কিছুর মালিক সে নয়। তখন সে বুঝে যায়, প্রকৃত মালিক কেবল আল্লাহ। রোগব্যাধি কেবল কষ্ট নয়, বরং এটি বান্দার জন্য ইমানের যাচাই, ধৈর্যের প্রশিক্ষণ এবং গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
রোগব্যাধি আমাদের ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহর এক বিশেষ আয়োজন। কখনো এটি আমাদের গুনাহ মাফের কারণ হয়, কখনো এটি আমাদের অন্তরের পরিশুদ্ধি আনে, আবার কখনো এটি আমাদের আল্লাহর আরও নিকটবর্তী করে তুলে। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলিমকে যদি কোনো ক্লান্তি, রোগ, দুঃখ, উদ্বেগ, কষ্ট বা দুশ্চিন্তা স্পর্শ করে, এমনকি যদি একটি কাঁটার খোঁচাও তার শরীরে লাগে, তাহলে আল্লাহ এর মাধ্যমে তার গুনাহ মাফ করেন।’ (সহিহ বুখারি)
বিপদে আল্লাহর হেকমতের বৈচিত্র্য : কোরআনের আয়াতসমূহ থেকে বোঝা যায়, বান্দাদের ওপর বিপদ আপতিত হওয়ার পেছনে আল্লাহর নানা হিকমত আছে। এর মধ্যে একটি বড় কারণ হলো ধৈর্যশীল ও সত্যনিষ্ঠ মুমিনদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদ ও প্রাণের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে। আর যদি তোমরা তখন ধৈর্যশীল হও, তাহলে সেটাই হবে বড় হিম্মতের কাজ।’ (সুরা আলে ইমরান ১৮৬) এই পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের ধৈর্য ও সংকল্প যাচাই করেন এবং তাদের মর্যাদা উঁচু করেন।
অপরাধীদের জন্য বিপদ সতর্কবার্তা : কোরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন অবিশ্বাসীরা তাদের কৃতকর্মের কারণে বারবার বিপদে পড়বে অথবা তাদের আশপাশে বিপদ আসবে যতক্ষণ না আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়। যখন অবিশ্বাসীরা দুষ্কর্ম ও অহংকারে মগ্ন হয়, আর মুমিনরা তাদের ব্যাপারে কিছু করতে অক্ষম থাকে, তখন আল্লাহ এমন নিদর্শন দেখান যা মানবজাতিকে তার শক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফিরে আসার আহ্বান : মহান আল্লাহ মানুষের পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পৃথিবীতে বিপদ ও মহামারী পাঠান, যাতে তারা সতর্ক হয় এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। কোরআনে এসেছে, ‘স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মানুষের কাজের কারণে, যাতে তারা কিছু শাস্তিভোগ করে এবং ফিরে আসে।’ (সুরা রুম ৪১)
এই ধরনের বিপদকে আল্লাহ বান্দাদের জন্য এক সতর্কবার্তা বানিয়েছেন। এগুলো মানুষকে তওবা, বিনম্রতা ও প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ করে। কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে ফিরে আসে, আবার কেউ গাফেল থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি বড় শাস্তির আগে ছোট শাস্তি দিই, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা সেজদা ২১) পূর্ববর্তী জাতিদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ একই নীতি অবলম্বন করেছেন। তাদের দারিদ্র্য ও রোগব্যাধিতে আক্রান্ত করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। কিন্তু যারা গাফেল থেকেছে, অতঃপর হঠাৎ তাদের পাকড়াও করা হয়েছে।
রোগব্যাধি হলে বান্দার করণীয় : যেহেতু রোগব্যাধি কিংবা যেকোনো বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা এবং এটি আল্লাহর পূর্বলিখিত তকদিরের অংশ, যা ঘটার তা ঘটবেই, আর যা ঘটবে না তা কখনো ঘটবে না। তাই প্রথম করণীয় হলো, আল্লাহ কর্র্তৃক নির্ধারিত তকদিরে বিশ্বাস রাখা এবং তার ওপর পূর্ণ ভরসা করা। কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, আল্লাহ আমাদের জন্য তকদিরে যা লিখে রেখেছেন, তাছাড়া অন্য কোনো কষ্ট আমাদের কিছুতেই স্পর্শ করবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর মুমিনদের উচিত আল্লাহর ওপরই ভরসা করা।’ (সুরা তওবা ৫১)
ধৈর্যধারণ ও শোকর আদায় : রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি খুবই আশ্চর্যজনক! তার প্রতিটি অবস্থাই কল্যাণকর। যদি সে সুখে থাকে, আর শুকরিয়া আদায় করে, তাহলে এটি তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আর যদি কষ্ট পায় এবং ধৈর্যধারণ করে, এটিও তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসে।’ (সহিহ মুসলিম) তাই রোগব্যাধি ও বিপদ-আপদে অস্থির ও হা-হুতাশ না করে আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করা উচিত।
ভয়েস/আআ